মোবাইল ফোন সার্ভিসিং-এ মাল্টিমিটারের ব্যবহার
মাল্টিমিটার একটি বহুমুখী পরিমাপক যন্ত্র যা ইলেকট্রনিক্স জগতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মোবাইল ফোন সার্ভিসিং-এর ক্ষেত্রে এটি একটি অপরিহার্য টুল হিসেবে বিবেচিত হয়। সার্কিট বিশ্লেষণ, কম্পোনেন্ট চেকিং, ভোল্টেজ ও কারেন্ট পরিমাপ, শর্ট সার্কিট খোঁজা, ট্র্যাক ট্রেসিং ইত্যাদি কাজে মাল্টিমিটার ব্যবহার করা হয়। মোবাইল ফোন সার্ভিসিং-এ মাল্টিমিটারের যথাযথ ব্যবহার একজন টেকনিশিয়ানের দক্ষতা ও পেশাগত সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
নিচে মোবাইল সার্ভিসিং-এ মাল্টিমিটারের ব্যবহারের বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
---
১. ডায়োড টেস্টিং (Diode Testing)
মোবাইল সার্কিটে অসংখ্য ডায়োড ব্যবহৃত হয়। এগুলোর মধ্যে কিছু রেকটিফায়ার ডায়োড, কিছু Zener ডায়োড এবং কিছু TVS ডায়োড হতে পারে। মাল্টিমিটারের diode mode ব্যবহার করে একটি ডায়োড ঠিক আছে কি না, তা সহজেই বোঝা যায়।
একটি ভালো ডায়োড শুধুমাত্র একদিকে বিদ্যুৎ প্রবাহ ঘটাবে।
মাল্টিমিটার দিয়ে ডায়োডের দুই প্রান্তে প্রোব স্পর্শ করিয়ে Forward ও Reverse Bias টেস্ট করা হয়।
ফলাফল অনুযায়ী ডায়োডটি ভালো না খারাপ তা নিশ্চিত করা যায়।
---
২. কনটিনিউইটি টেস্ট (Continuity Test)
মোবাইল সার্কিটে কোনো ট্র্যাক কাটা আছে কি না, শর্ট সার্কিট হয়েছে কি না তা চেক করার জন্য কনটিনিউইটি মোড ব্যবহার করা হয়।
মাল্টিমিটারটি যখন কনটিনিউইটি মোডে থাকে, তখন প্রোব দুই প্রান্ত সংযুক্ত করলে বিপ শব্দ হয়।
একটি ট্র্যাকের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সিগন্যাল যাচ্ছে কি না, তা বোঝা যায়।
কোনো কম্পোনেন্ট শর্ট হয়েছে কি না, তাও পরীক্ষা করা যায়।
---
৩. ভোল্টেজ মাপা (Voltage Measurement)
মোবাইল সার্কিটে বিভিন্ন IC ও কম্পোনেন্টে সঠিক ভোল্টেজ সরবরাহ হচ্ছে কি না, তা যাচাই করা হয় মাল্টিমিটার দিয়ে।
ফোন চালু অবস্থায় DC ভোল্টেজ মোডে মাল্টিমিটারের সাহায্যে পাওয়ার লাইনগুলো পরীক্ষা করা হয়।
CPU, PMIC, Charging IC, Display Connector ইত্যাদির নির্ধারিত পিনে ভোল্টেজ রয়েছে কি না তা চেক করা হয়।
ভোল্টেজ কম বা বেশি হলে কম্পোনেন্টে সমস্যা হতে পারে।
---
৪. রেজিস্ট্যান্স মাপা (Resistance Measurement)
কোনো রেজিস্টার সঠিকভাবে কাজ করছে কি না তা যাচাই করা হয় রেজিস্ট্যান্স মাপার মাধ্যমে।
মাল্টিমিটার দিয়ে রেজিস্টরের দুই প্রান্তে প্রোব স্পর্শ করিয়ে তার রেজিস্ট্যান্স মান দেখা হয়।
রেজিস্ট্যান্স মান যদি রঙ কোড বা লেখা অনুযায়ী না হয়, তবে রেজিস্টারটি ড্যামেজ।
শর্ট বা ওপেন রেজিস্টার চিহ্নিত করা সহজ হয়।
---
৫. কারেন্ট মাপা (Current Measurement)
কারেন্ট মাপা তুলনামূলকভাবে কম করা হয়, কারণ এতে সার্কিট কাটতে হয়। তবে কোনো লোডে কত অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট প্রবাহিত হচ্ছে, সেটা জানা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়।
কারেন্ট মাপার জন্য সার্কিটের মধ্যে মাল্টিমিটার সিরিজে বসাতে হয়।
সাধারণত ব্যাটারি লাইনে কারেন্ট চেক করে বোঝা যায় ফোনে শর্ট হয়েছে কি না।
কারেন্ট বেশি হলে শর্ট বা ফোর্স লোড থাকতে পারে।
---
৬. শর্ট সার্কিট চিহ্নিতকরণ
মোবাইল ফোনে শর্ট সার্কিট হলে সেট অনই হয় না বা রিস্টার্ট নেয়। মাল্টিমিটার দিয়ে শর্ট পরীক্ষা করা হয় কনটিনিউইটি মোডে।
ব্যাটারি কানেক্টর পজিটিভ ও নেগেটিভ লাইনে প্রোব ধরলে বিপ শব্দ হলে বোঝা যায় শর্ট হয়েছে।
শর্ট চিহ্নিত করার পরে মাল্টিমিটার দিয়ে বিভিন্ন ক্যাপাসিটার, কুয়েল ও IC চেক করে সমস্যার উৎস খোঁজা হয়।
---
৭. ক্যাপাসিটার ও কুয়েল পরীক্ষা
ক্যাপাসিটরের শর্ট বা ওপেন অবস্থায় মাল্টিমিটার দিয়ে পরীক্ষা করা যায়।
সাধারণত ক্যাপাসিটরের দুই প্রান্তে মাল্টিমিটারের প্রোব ধরলে একটু রিডিং গিয়ে আবার শূন্যে ফিরে আসবে।
কুয়েল ঠিক থাকলে তার রেজিস্ট্যান্স খুবই কম হবে (০ থেকে ১ ওহম)।
শর্ট কুয়েল সবসময় কনটিনিউইটি দিবে এবং ওপেন কুয়েল কিছুই দেখাবে না।
---
৮. পাওয়ার বাটন ও ভলিউম বাটন চেক করা
মোবাইলের পাওয়ার ও ভলিউম বাটন ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তা মাল্টিমিটারের সাহায্যে পরীক্ষা করা হয়।
মাল্টিমিটার কনটিনিউইটি মোডে নিয়ে বাটনের দুই প্রান্তে প্রোব ধরলে বোতাম চাপার সময় বিপ শব্দ আসবে।
কোনো শব্দ না হলে বোঝা যায় বোতামটি কাজ করছে না।
---
৯. চার্জিং লাইন ও ইউএসবি পোর্ট পরীক্ষা
মোবাইলের চার্জিং সমস্যা হলে চার্জিং লাইন ও ইউএসবি পোর্ট পরীক্ষা করা হয় মাল্টিমিটার দিয়ে।
ভোল্টেজ চেক করে দেখা হয় VBUS, D+ এবং D- লাইনে সঠিক সিগন্যাল আসছে কি না।
শর্ট থাকলে কনটিনিউইটি দিয়ে চেক করে শর্ট করা ক্যাপাসিটর বা IC খুঁজে বের করা হয়।
---
১০. ব্যাটারি টার্মিনাল পরীক্ষা
ফোনের ব্যাটারিতে পজিটিভ ও নেগেটিভ টার্মিনালে ভোল্টেজ ঠিক আছে কি না, সেটাও মাল্টিমিটারের সাহায্যে জানা যায়।
ব্যাটারি ভালো থাকলে ৩.৭ থেকে ৪.২ ভোল্ট পাওয়া যায়।
এর নিচে বা ওপরে হলে ব্যাটারি নষ্ট বা অতিরিক্ত চার্জড।
---
১১. আইসি ও কম্পোনেন্ট শর্ট/খারাপ চেক করা
মোবাইল সার্কিটে অনেক ছোট ছোট IC ও কম্পোনেন্ট থাকে। এগুলোর শর্ট বা খারাপ হওয়া চিহ্নিত করতে মাল্টিমিটার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
PMIC, Charging IC, Power IC, Audio IC ইত্যাদি চেক করে জানা যায় শর্ট হয়েছে কি না।
অনেক সময় আইসির ভেতরে শর্ট হলে সেটা চিহ্নিত করা যায় মাল্টিমিটারের সাহায্যে।
---
১২. ট্র্যাক ট্রেসিং (Track Tracing)
মোবাইলের পিসিবির মধ্যে কোনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে কি না তা বোঝার জন্য মাল্টিমিটার দিয়ে ট্র্যাক ট্রেস করা হয়।
এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে মাল্টিমিটার দিয়ে চেক করে ট্র্যাক ঠিক আছে কি না বোঝা যায়।
কোন লাইন কোথা থেকে কোথায় গেছে তা বোঝা যায় মাল্টিমিটার দিয়ে অনুসরণ করে।
---
উপসংহার
মোবাইল সার্ভিসিং-এর জগতে মাল্টিমিটার একটি অপরিহার্য টুল। এর সাহায্যে ফোনের হার্ডওয়্যার সমস্যা সহজে চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করা যায়। মাল্টিমিটার ছাড়া কোনো মোবাইল টেকনিশিয়ান সঠিকভাবে ফোন সার্ভিসিং করতে পারে না বললেই চলে। এটি যেমন খরচ সাশ্রয়ী, তেমনি বহনযোগ্য এবং ব্যবহারেও সহজ। তবে এর সঠিক ব্যবহার জানতে হলে কিছু প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকা দরকার।
যেকোনো ভালো সার্ভিসিং টেকনিশিয়ানের হাতে সবসময় একটি মাল্টিমিটার থাকা আবশ্যক। এটি মোবাইল ফোনের প্রাণরক্ষাকারী হিসেবে কাজ করে এবং নানান জটিল সমস্যার সমাধানে অমূল্য সহযোগিতা করে।
0 Comments